পর্ব - ১
সে বড়
অগম দুর্গ। সাত পরিখা, সাত পাহাড়, সাত সহস্র প্রহরী পেরিয়ে তবে দেখা মেলে ফটকদ্বারের। সেই প্রাসাদে এক সুরক্ষিত ঘরে সোনার খাটে ঘুমায় রাজকুমারী। বৃদ্ধ রাজার শেষ বয়সে লাভ করা সাত রাজার ধন এক মানিক। রাজার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে সার কারখানা, আরও কত কী! রাজকুমারীর সাথে অবশ্য ঘুমায় রাজার জামাইও। আরেক ভিন রাজ্যের রাজকুমার। অনেক দেখে শুনে রূপে গুনে মুগ্ধ হয়ে যার সাথে রাজকুমারীর বিয়ে দেয়া হয়েছে। রাজকুমারী ভোরে উঠে শিউলিফুল কুড়ায়, রাজপুত্র তাই দিয়ে মালা গেঁথে তাকে পরায়। রাজকুমারী সকাল হলে গলা খুলে গাইতে বসে, রাজকুমার সাথে তবলা বাজায়। রাজকুমারী দুপুরবেলা হরিণ চোখে চায়, রাজকুমার রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গিয়ে শিকার করে আনে মায়ামৃগ। রাজকুমারী সাঁঝের বেলা প্রদীপ জ্বালায়, রাজকুমার তার হৃদয় দিয়ে সলতে হয়ে জ্বলে।
এই রাজার রাজ্যে সবাই সুখী। প্রজারা সুখী, রাজকন্যা এবং তার জামাই সুখী, রাজার পাত্র মিত্র অমাত্য সবাই সুখী, রাজকন্যার সখিরা সুখী। সর্বত্র রাজার জয়ধ্বনি, এমনকি রাজ্যের পশুপাখিরাও রাজার সুখে সুখী। কিন্তু একদিন হঠাৎ......
নিতাই জন্মেছিল বেশ ভদ্রঘরেই। বাবা ছিলেন যাত্রার মাস্টার আর মা গান গাইতেন অপূর্ব। কিন্তু নিতাই তার সমস্ত প্রতিভা নিয়ে চোর হোল (তারাশংকরের কবির উল্টাপীঠ দ্রষ্টব্য)। ঘরে ঘরে সিঁদ কাটাই তার নেশা। দিন তার ঘুমে কাটে আর রাতগুলো যেন শিল্প। আহ, যেমন তার অধ্যাবসায় তেমনি তার হাতসাফাই। নিজ গ্রাম আর আশপাশের দশগ্রাম যখন তার প্রতিভায় নাজেহাল তখন তার নিজেরই একদিন মনে বিবাগ এলো। এসব যেনতেন কর্মে তো আর মন
ভরেনা। এ যেন নিজের পকেট নিজে কাটা। তো, কি এমন করা যায় যাতে নিজের কীর্তি ফোটে? এমনি এক সময়, আশ্বিনের মাঝামাঝি, পূজার ঢাক উঠলো বাজি...
ইচ্ছেপুর গ্রামের নাম প্রায় সব্বাই জানে। প্রতিবার দুর্গাপূজার সময় এখানে যা জমজমাট মেলা হয়! পোড়ামাটির পুতুল, হরেক রকম মণ্ডা-মেঠাই, নাগরদোলা, সঙ, নকশীকাঁথা আর
মহিষাসুরমর্দিনী যাত্রাপালা... কি না
হয় সেখানে? গ্রামের দশজন আর
দশ গ্রামের শতেক জন, কতনা ভিড় হয়! রাজকুমারী অনেকবার ভেবেছে একটিবার যাবে সেই মেলায়। কিন্তু রাজার নিষেধ আর অবরোধে তার কি জো
হয়েছে এতদিন? এবার রাজকুমারীর আঠারো বছর পূর্ণ হোল। আর
বিয়েও হয়ে গেছে। তাই হঠাৎ রাজপ্রাসাদ জুড়ে সোর উঠলো, রাজকুমারী জেদ ধরেছে ইচ্ছেপুরের মেলায় যাবে। রাজা এসে নিষেধ করে কত বোঝালে, রাণীরা এসে কত ভয়
দেখালে,
রাজপুত্র বর এসে কত
চোখের জল ফেল্লে,কিন্তু রাজকন্যের সেই এক গোঁ, সে মেলায় যাবেই যাবে, নিজের হাতে পুতুল কিনবে, নিজের চোখে পালা দেখবে। রাজা বললে, ঠিক আছে ও সব আমি প্রাসাদে আনিয়ে দেই? শুনে রাজকন্যে দিনমান উপোষ করে রইলো। রাজপুত্র বর বললে, পালা তবে এবার রাজপ্রাসাদের আঙ্গিনায় হোক? শুনে রাজকন্যে রাতে অন্যঘরে গিয়ে দুয়ার দিলো। অবশেষে সবাই হার মানল রাজকন্যের জেদের কাছে। ঠিক হোল পাল্কী চেপে রাজকন্যে যাবে মেলা দেখতে। সাথে থাকবে তার বর, সাতজন সখী আর সাতশত পেয়াদা। ও মা, তাতেও রাজকন্যে নারাজ। সে যেতে চায় তার খাস দাসী ইন্দিরা আর
তার কথা কওয়া ময়নার সাথে। আর কারুকে সে
সঙ্গে নেবেনা। কি আর করা, একমাত্র মেয়ের জেদের কাছে রাজামশায় নতি স্বীকার করলেন। আর
সাব্যস্ত হোল মহাষ্টমীর দিন রাজকন্যে পাল্কী চেপে মেলায় যাবে। দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে...
নিতাই পুজা শুরুর দিনই ইচ্ছেপুর গ্রামে এসে হাজির হয়েছে। এরকম বড়
মচ্ছব তার খুব প্রিয়। হাজারও মানুষ, কত কোলাহল। খরচও লাগেনা, ইচ্ছেমত হাতসাফাই করে যা দরকার নিয়ে নাও। তবে এবার তার মূল লক্ষ্য বড় কিছু করা। ছোটখাটো কাজে আর মন লাগেনা। মেলার এক কোণায় এক লোক চাকু দিয়ে মানুষ কাটার খেলা দেখাচ্ছিল। অনেক লোক ভিড় করেছে সেখানে। নিতাইও কিছুক্ষন দেখল। মামুলি সব
কৌশল। দেখতে দেখতে নিতাইএর ক্ষিধে পেয়ে গেল। পাশের এক লোকের পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বটুয়াটা উঠিয়ে নিয়ে সে আরেক পাশে ময়রার দোকানে যেয়ে বসলো। আহ বেড়ে গন্ধ বেরিয়েছে লুচি আর
আলুর দমের। এক চাঙারি কিনে নিয়ে তাই খেতে লাগলো। পাশে এক বুড়ো ঝিমাচ্ছিলো, বোধহয় আফিম খেয়ে।একটু পর
ঢুলুঢুলু চোখে নিতাই এর
দিকে তাকিয়ে বলল, " কি হে, এ রকম কাঁচা কাজ করেই খাস নাকি?" নিতাই চমকে উঠে বলল, " কি বললে খুড়ো?" বুড়ো ফিচেল হেসে বলল, "বটুয়াটা যে
তুল্লি,
এতো এত দূর থেকেও পষ্ট দেখলাম। ধুর, সে রকম হাতের কাজই আর নেই আজকাল।" নিতাইএর হাত থেকে লুচির চাঙারি পড়ে গেল। বুড়ো উঠে আস্তে আস্তে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। নিতাই হাত মুছে উঠতে না উঠতে বুড়ো হাওয়া। মাথায় রইলো খাওয়া, নিতাই বুড়োর খোঁজে ভিড় ঠেলে এদিক ওদিক ছুটতে লাগলো। সে বুঝে গেছে এ বুড়ো ওস্তাদ লোক। এর কাছেই পাবে সে মনের মত কাজের হদিস। এপার থেকে ওপার, এধার থেকে ওধার, চক্করের পর চক্কর চালিয়েও নিতাই বুড়োর কোন পাত্তাই পেলোনা। বুড়ো যেন ভোজবাজির মত হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে হোল। সূর্য্যিমামা পশ্চিম দিকটা পুরো লাল করে পাটে বসলেন। নিতাই হাল ছেড়ে দিয়ে ইছামতি নদীর ধারে গিয়ে বসলো। বেশ বড়
বটগাছ,
এখান ওখান দিয়ে ঝুরি নেমেছে অনেক। তারই ফাঁকে ফাঁকে আলোছায়ার চিকরি মিকরি। নদীর পাড় ঘেঁষে দুইটা নৌকা উল্টে রাখা ডাঙ্গায়, আলকাতরার কাজ চলছে। নদীর জলো হাওয়া একটু যেন কাঁপন ধরালো নিতাইএর গায়ে। খিদেটাও যেন কামড় দিচ্ছে পেটে। কিন্তু সব ভুলে নিতাই ভাবতে লাগলো বুড়োটার কথা। কি আশ্চর্য, যে নিতাই এর বাঁ হাতের কাজ ডান হাত টের পায়না, সেই কাজ কিনা এক
হাঘরে বুড়ো অত দূর থেকে ঠিক নাগাল করে নিলো? তবে কি
তার এত বছরের শিক্ষা, পরিশ্রম সব মিছে? এতসব ভাবতে ভাবতে কখন যে
নিতাই বটগাছের গায়ে হেলান দিয়ে ঝিমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি। হঠাৎ ঘুমের ঘোরে যেন শুনতে পেলো, "কি রে
ব্যাটা?
আমাকে খুঁজছিলি ক্যানে?" নিতাই চমকে জেগে উঠলো। কণ্ঠস্বর সে চিনতে পেরেছে। পেছনে তাকিয়েই দেখতে পেল বটগাছের এক
মোটা শিকড়ের উপর বসে রয়েছে সেই বুড়ো। রাত নেমে গিয়েছে কখন। তবু প্রতিপদের চুইয়ে পড়া চাঁদের আলোয় বুড়োকে সে দিব্যি দেখতে পাচ্ছে। নিতাই উঠে ধীর পায়ে বুড়োর কাছে গিয়ে বসল। একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো,
- তুমি কে
গো?
- তা জেনে তোর কাজ কি?
- না, আসলেই তুমি ওস্তাদ লোক। আজ
অব্দি কেউ আমার ছায়ারও হদিস পায়নি। তুমি অতদুর থেকে ঠিক দেখে ফেললে?
বুড়ো একটু ম্লান হাসে। বলে,
- দেখাটাই তো
আসল রে। সবাই তো
তাকায়,
দেখে কজন? তা তোর ব্যাপার কি? এ মেলায় ঘুরছিস ক্যানে? দেখে তো মনে হয় না যে
শুধু ট্যাঁক কাটার জন্য এখানে এয়েছিস?
- তুমি সব
জান বাবা। তবু বলি, ছোটখাটো কাজে আর তো
মন ওঠেনা। একটা বড়
কিছু যদি করতে পারতাম, অসম্ভব গোছের কিছু ! কিন্তু কি
যে করবো তারই তো
হদিস পাচ্ছিনে।
বুড়ো যেন এবার একটু বিরক্ত হয়। উঠে পড়তে পড়তে বলে,
- সে এলেম তোর এখনও হয়নি।
নিতাই তার পা চেপে ধরে। আকুল গলায় বলে,
- দয়া কর
বাবা। একটা কিছু বলে যাও। এই দগ্ধে মরা আর ভাল লাগেনা।
বুড়ো সামনের দিকে চেয়ে থাকে। সেখানে নদীর পাড় জুড়ে বিশাল কাশের বন। চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করছে। খানিক থেমে বলে,
- নিঝুমগড়ের রাজার নাম শুনেছিস?
- হা বাবা। শুনেছি সেই রাজ্যের রাজকন্যে এবার মেলায় আসবে-
- হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছিস। তো সেই রাজকন্যের এক আজব ময়না আছে। মুখে তার হরেক বুলি। গানও গায় অপূর্ব। রাজকন্যের সে বড় প্রিয়। সারক্ষন আগলে রাখে। পারিস তো যা, সেই ময়না নিয়ে আয়।
- সে আর
এমন কি? শুনলাম তো রাজকন্যে নাকি সেই ময়না নিয়েই মেলায় আসছে। এখান থেকেই সে
পাখি আমি সরিয়ে ফেলব।
- উঁ হু। মেলার ডামাডোলে ও কাজ তো আনাড়িও পারে। তোকে সে পাখি আনতে হবে রাজপ্রাসাদের কড়া প্রহরা ভেঙ্গে। তবেই না বলি বাহাদুর। তবে আবার ভেবে দেখিস। এ প্রায় অসম্ভব কাজ। প্রান হারানোর সম্ভাবনাই বেশি।
- তা হোক। সে পাখি আমি প্রাসাদ থেকেই আনবো। কিন্তু তারপর তোমারে আমি কোথায় খুঁজে পাব?
- আমি খবর ঠিকই পাব। আর
আমারে কেউ খুঁজে পায়না। আমার ইচ্ছা হলে আমি দেখা দেই।
বুড়ো চলে যায়। তার উড়তে থাকা সাদা দাড়ির সাথে মিশে যায় কাশবনের রঙ। নিতাই হথাৎ খেয়াল করে বুড়ো কি যেন ফেলে গেছে। হাতে নিয়ে দেখে কলাপাতায় চিড়ে, কলা আর গুড়। কৃতজ্ঞতায় নিতাইএর চোখে জল আসে। সামনে তাকিয়ে দেখে বুড়ো আবার হাওয়া। হঠাৎ নিতাইএর মাথায় কি
যেন উঁকি দেয়। বুড়ো শেষ কথা যেন কি বলল, "আমারে কেউ খুঁজে পায়না। আমার ইচ্ছা হলে আমি দেখা দেই"... এ কথা তো সে শুনেছে অনেকের মুখে! কিন্তু সে
তো অনেক আগের কথা! তা কি করে হয়? তবে কি সে এখনও বেঁচে?
সকালটা বড়
অদ্ভুত। আকাশের গায়ে কে যেন অনেকক্ষণ ধরে সিঁদুর লেপেছে। আর ইছামতি নদীটার বেহায়াপনাটা একবার দেখ! আকাশের রঙ যেন পুরোটা গায়ে মেখে নির্লজ্জ হাসছে। আজ মহাষ্টমী। ইচ্ছেপুরের পূজার মেলায় ভোর থেকেই সাজ সাজ রব। হবে নাই বা
কেন?
আজ রাজকন্যে আসবে না? তা রাজকন্যে যতই জেদ করুক রাজামশাই তো
আর অমনি ছাড়বার মানুষ নন। আজ মেলায় পসরা সাজানো ব্যাপারীরা ছাড়া লোক সমাগম বড়ই কম। আছে সবাই। দূর থেকে দেখছে। অপেক্ষা করছে রাজকুমারীকে এক পলক দেখবার জন্য। আজ আবার মেলায় নতুন আরেকটা খেলা হবে। কে এক ভিনদেশের তীরন্দাজ লক্ষ্যভেদের খেলা দেখাবে। তার তোড়জোড়ও চলছে পুরোদমে।
নিতাই অনেক বেছে একটা প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের ডালে চেপে বসলো। হ্যাঁ, এখান থেকে পুরো মেলাটা দিব্যি ঠাহর হয়। রাজকন্যে নিয়ে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তবে তার ময়নাটা দেখতে হবে। কেমন তার দেখনবিচার আর
কিইবা তার চালচলন। কোঁচড়ে মুড়ি আর পাটালি গুড় নিয়ে সে
বেশ জাঁকিয়ে বসলো।দুর্গামণ্ডপে অঞ্জলি শেষ হল। হঠাৎ চারিদিকে শোরগোল উঠলো...রাজকন্যের পাল্কী আসছে। নিতাই ডান দিকে তাকিয়ে দেখল আলপথ পেরিয়ে বেশ চটকদার এক
পাল্কী এগিয়ে আসছে। নিতাই নড়েচড়ে বসলো। ওইতো এগিয়ে আসছে তার স্বপ্ন পূরণের চাবি।
সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে জনতা। একটু আগেও গুঞ্জন ছিল। এখন সবাই নিশ্চুপ। শুধু ইছামতি নদীর স্রোতের কুলুকুলু শব্দ কানে আসে। রাজকন্যের পাল্কী এসে মেলার মাঝখানে থামল। বেহারারা পাল্কী নামিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রথমে পাল্কী থেকে নামলো রাজকন্যের খাস দাসী ইন্দিরা। তারপর ধীরে ধীরে নামলো রাজকন্যা। পরনে তার বহুমুল্য রাজপোশাক, গায়ে তার মনি-মুক্তার অপরূপ কারুকাজ। জনতা দূর থেকে জয়ধ্বনি দিলো রাজকন্যের নামে।
এত দূরে গাছের ডালে বসেও নিতাই দেখল এক
দেবীকে। বহুমুল্য বসনও যার কাছে ম্লান। সূর্যের আলো যেন পিছলে যাচ্ছে ওই সোনার অঙ্গে। কিন্তু তার নজর আটকে রইল রাজকন্যের হাতে বসা সোনার শেকলে বাঁধা ময়নার দিকে। রাজকন্যা এবার মেলা দেখতে বের হোল। আজ
সব ব্যাপারীরা তাদের সেরা পসরা সাজিয়ে বসেছে। রাজকন্যা পোড়ামাটির পুতুল, রেশমি চুড়ি বেলোয়ারী, কাঠের তৈরি খেলনা, কতকিছু কিনল। হাওয়াই মিঠাই, প্যাঁড়া সন্দেশ কত
কিছু চেখে দেখল। কতরকম খেলা দেখল। তবে নতুন আসা তীরন্দাজের খেলা দেখে সে
খুব অবাক হোল। তীরন্দাজ মাঠে এলো মুখোশ পরে। অদ্ভুত তার নিশানা। আকাশে তীর ছুঁড়ে আরেক তীরে তাকে দুভাগ করে দেখালে, একশ হাত দূর থেকে একটা আমলকী ফুঁড়ে দেখালে, আরও কত
রকম!
রাজকন্যা তার দাসীকে দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলো যে এক দুর্ঘটনায় তীরন্দাজের মুখ পুড়ে যাওয়ায় সে সবসময় মুখোশ পরে খেলা দেখায়। তবু তার মনের খচখচানি গেলনা। কারন তীরের এমন অব্যর্থ লক্ষ্য তার জানা একজনেরই মাত্র আছে। সে হচ্ছে রাজকুমার, তার স্বামী!
মন ভরে মেলা দেখল রাজকন্যা। আশ মিটিয়ে ঘুরল ফিরল। তারপর ফিরে এলো পাল্কীর কাছে। পাল্কিতে ওঠার আগে সবার দিকে চেয়ে বলল,
- শোন গো
ইচ্ছেপুরের ভালমানুষেরা, আমি খুব খুশি হয়েছি তোমাদের মেলায় এসে। তাই ভাবছি আমার খুব প্রিয় একটা জিনিসের ভাগ তোমাদেরকেও একটু দেব।
জনতা উৎসুক হয়ে শুনতে লাগলো। রাজকন্যা বলে চলল,
- আমার এই
ময়না যেন স্বর্গের গান গায়। এই গান শুনতে পাই কেবল আমি আর কাছের মানুষেরা। আজ আমি তোমাদের সেই গান শোনাব।এই বলে রাজকন্যা তার ময়নার শেকল খুলে দিল। ময়না উড়ে গিয়ে বসলো একটা উঁচু খুঁটিতে। তারপর সে ধরল গান,
"মন ভোলান সোনার শেকল বান্ধা আমার পায়
আরও হরেক বাঁধন আছে কজন দেখতে পায়?
আমার নাহয় ভালবাসায় বান্ধা আছে ডানা,
আমার নাহয় খুঁজতে বারণ আকাশের ঠিকানা,
তুমি তো
ভাই মনের মানুষ, মনের ভেতর বাস,
তবু কেন উড়াল দিতে এত
দীর্ঘশ্বাস..."
গেয়ে চলল ময়না।আহা, কি সে কণ্ঠ! আহা, কি তার দরদ! শরতের নীল আকাশ যেন রামধনুর সাত রঙে ভরে গেল। জনতা চিকচিকে ভেজা চোখ নিয়ে সেই সুরের মায়ায় তন্ময় হয়ে রইল। রাজকন্যা পালকি নিয়ে চলে যাবার পরও যেন সেই সুরের রেশ রয়ে গেল ইচ্ছেপুরের আকাশ বাতাস আর ইছামতির ঢেউ জুড়ে।
নিঝুমগড়ের আকাশ আজ দারুণ নীল। কোথাও একটুকরো মেঘের দেখাও নেই। থেকে থেকে কার্তিকের হাল্কা শীতের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। মানুষ মনের আনন্দে ঘুরছে ফিরছে, কাজ করছে। এ রাজ্যের রাজার সবার সুখের দিকে খেয়াল। রাজপথের অনেক জায়গায় বেশ কতগুলো সরাইখানা করে দিয়েছেন দূরাগত পথিকদের জন্য। সেখানে বিনামুল্যে আশ্রয় আর স্বল্পমুল্যে খাবার মেলে।সেরকমই এক সরাইখানায় দুপুরের কিছু আগে এক পাখিওয়ালা এসে উপস্থিত হল। কাঁধে তার অনেকগুলো খাঁচায় হরেক রকম পাখি। ময়না, টিয়া, কাকাতুয়া, বুলবুলি, টুনটুনি, আরও কতরকম। পেছন পেছন বেশ কিছু বাচ্চারাও জড় হয়েছে হরেক রকম পাখি দেখে। তারা হাসছে আর
থেকে থেকে বিভিন্ন পাখির ডাক ডেকে দুষ্টুমি করছে। পাখিওয়ালা খাঁচাগুলো সরাই এর বারান্দায় নামিয়ে রেখে হাঁক পাড়ল,
-কই গো, কেউ আছেন নাকি? আমি অনেক দূরদেশ থেকে আসছি। এখানে একটু আশ্রয় মিলবে?
হাঁকডাক শুনে বেরিয়ে এলো সরাই এর দায়িত্বে যে
আছে। বুড়ো মানুষ। আগে পাঠশালায় পড়াত।নাম শাজাহান মিয়াঁ। এখন অবসর নিয়ে এই রাজসরাইখানা দেখাশোনা করে। পাখিওয়ালাকে দেখে বলল,
-আরে এসো এসো, ভেতরে এসো। অনেক দূর থেকে আসছ মনে হচ্ছে। তুমি পথিক। এ রাজ্যে অতিথি। অবশ্যই আশ্রয় মিলবে।
তারপর বাচ্চাদের দিকে চোখ পড়তেই তাদেরকে মৃদু ধমক দিয়ে বিদায় করে দিল। পাখিওয়ালা খাঁচাগুলো নিয়ে ভেতরে ঢুকল। শাজাহান মিয়াঁ খাঁচাগুলো ভেতরের উঠানে রাখার ব্যাবস্থা করে পাখিওয়ালাকে তার ঘর দেখিয়ে দিয়ে বলল,
-তুমি পরিশ্রান্ত।সরাই এর পেছনে একটা কুয়া আছে। সেখানে স্নান সেরে খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম কর। বিকেলে কথা হবে।
পাখিওয়ালা ঘরে ঢুকে দেখল দিব্যি পরিপাটি করে সাজানো সবকিছু। বেশ কয়েকটি খাটিয়া পাতা আছে। সেগুলোর উপর ধবধবে চাদর বালিশ বিছানো। কোণার দিকে জানালার পাশের খাটিয়াটা পছন্দ হল
তার। সেখানে বসে কাঁধের ঝোলাটা নামিয়ে রাখল সে। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। সত্যি খুবই সুন্দর রাজ্য এই
নিঝুমগড়।
বিকেলে যখন তার ঘুম ভাঙল তখন পশ্চিমের আকাশ প্রায় লাল হয়ে এসেছে। একে পথ
হাঁটার পরিশ্রম তার উপরে দুপুরের ভরপেট খাওয়া, দুটো মিলিয়ে ঘুমখানা বেশ জব্বরই হয়েছে। হাত মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে সে সরাই এর বৈঠক ঘরের দিকে এগোল। উঠানে পাখিগুলো দিব্যি আছে। তাদেরকে দানাপানিও দেয়া হয়েছে। শাজাহান মিয়াঁর প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল সে। সত্যি এখানকার মানুষগুলো বেশ।
বৈঠকঘরে ঢুকে দেখল বেশ কয়েকজন মানুষ বসে দিব্যি মজলিস জমিয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় এটা তাদের নিত্যদিনের আড্ডা। তাকে দেখেই শাজাহান মিয়াঁ হইহই করে উঠলো,
-আরে এসো এসো ভিনদেশী। তোমার জন্যই তো আমরা বসে আছি। তোমার মুখে তোমার দেশের গল্প শুনব বলে। বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছিলে বলে আর ডাক দেইনি।
পাখিওয়ালা হাসিমুখে সবার দিকে তাকিয়ে অভিবাদন করল। তার বহুমানুষ দেখা চোখ নিমেষেই বুঝে গেল এরা সব আড্ডাবাজ লোক। এদের সাথে ভাব জমাতে পারলে অনেক কিছু জানা যাবে এখানকার হালচাল সম্বন্ধে। সেও খোশমেজাজে তাদের মাঝে গিয়ে বসল। ওদের মধ্যে এক বুড়ো, যাকে দেখলে যাত্রার অভিনেতা বলে মনে হয় সে
বেশ জাঁকিয়ে বসে বলল,
-অতিথি শুনলাম তুমি অনেক দূরদেশ থেকে আসছ। তা তোমার নামটা কি ভাই?
পাখিওয়ালা একদৃষ্টে তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। তারপর একটু হেসে বলল,
-নিতাই। লোকে ডাকে পক্ষী নিতাই বলে। পাখি ফেরি করিতো, তাই।
এ কথায় সবাই হো হো
করে হেসে উঠলো। দুএক জন হেঁকে বলল, “পক্ষী নিতাই! দারুণ নাম হে!” নিতাইও সবার সাথে সেই হাসিতে যোগ দিল। এদের সাথে মিশ খাওয়া খুব দরকার। কথায় কথায় গল্প জমে
ওঠে। নিতাই শোনায় তার দেশের গল্প, পথের গল্প, তার পাখি ধরার গল্প। এরা শোনায় এদের
রাজ্যের গল্প, রাজা-রাজকন্যের গল্প, রাজার বীর জামাতার শিকারের গল্প, এখানকার সুখ
স্বাচ্ছন্দ্যের গল্প। গল্পে গল্পে রাত হয়। মজলিস ভাঙে। সবাই উঠে বাড়ির দিকে পা
বাড়ায়। যাবার আগে সেই বুড়ো, যাকে দেখলে যাত্রার অভিনেতা মনে হয়, সে বলে গেল, “তা
ভাল জায়গাতেই এসেছ পাখিওয়ালা। এখানে তোমার পাখি বিক্রিও হবে ভাল আর পাশের বনে গেলে
পাখি মিলবেও এন্তার। ধরে নিয়ে অন্যস্থানে বিক্রি করতে পারবে”। নিতাই তাকে হাসি
দিয়ে ধন্যবাদ জানায়। রাতে খেয়ে দেয়ে নিজের কামরায় এসে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে নিতাই।
অনেক কিছুই জানা গেল এখানকার সম্পর্কে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, এই
রাজ্যের জামাই রাজপুত্র প্রতি মাসের প্রথম শনিবার মৃগয়াতে বের হয়। আজ মাসের প্রথম
বৃহস্পতিবার। পরশু দিনই রাজপুত্র শিকারে বের হবে। নিতাই এর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে
ওঠে। সে রাজপ্রাসাদে প্রবেশের উপায় পেয়ে গেছে। পাশ ফিরে শোয় নিতাই। আর প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে। কাল সকাল সকাল উঠে পড়তে
হবে। ঘুরে দেখে আসতে হবে চারপাশ। বিশেষ করে বনের দিকটা। কোথাও একটা নিশাচর পাখি ডাকতে থাকে।
চাঁদ ধীরে ধীরে উঠে আসে মাঝ আকাশে। দূরে রাজপ্রাসাদে ময়না রাজকুমারীকে ঘুমপাড়ানি
গান শোনায়। কিন্তু এর কোন কিছুই নিতাই এর কানে যায়না।
শনিবার প্রত্যুষ। পাহাড়ের গা বেয়ে লাল থালার মত সূর্যটা উঠে আসছে। রাজপ্রাসাদের ফটকদ্বার খুলে যায়। পিঙ্গলবর্ণ তেজী ঘোড়ায় চেপে বের হয়ে আসে
রাজ্যের জামাতা রাজকুমার। তার সাথে আরও কিছু সেনা ও বরকন্দাজ। অগ্রবর্তীরা গতকালই বনে যেয়ে শিবির ফেলে
প্রস্তুত হয়ে আছে। রাজপুত্রের পরনে শিকারির পোশাক। বুকে শক্ত চামড়ার বর্ম আঁটা।
পিছনে ঈষৎ বাঁকা হয়ে ঝুলছে ধনুক। কাঁধ থেকে ঝুলছে তীরভর্তি তূণ। ঘোড়ার পাশে বাঁধা
আছে সুতীক্ষ্ণ বর্শা। ঊষার আলোয় সুদর্শন কুমারকে দেখাচ্ছে যেন যোদ্ধাবেশী কোন
দেবতার মত। প্রিয় ঘোড়া দ্রুতকের পিঠে চেপে উল্কার বেগে বেরিয়ে গেল কুমার। বাকিরা
অনুসরণ করল তাকে।
বনের গা ঘেঁষে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে শিবির পড়েছে। অদূরে বড় বড়
কয়েকটি চুলা বানিয়ে রান্না চাপানো হয়েছে। বাতাসে ভাসছে ঘি মশলার সুবাস। শিবিরে
ঢুকে গোলাপের পাপড়ি মেশানো ঈষদুষ্ণ জলে হাত মুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে নিলো কুমার।
তারপর সেরে নিলো প্রাতঃরাশ। শিকারের জন্য প্রস্তুত হতে হতে ভাবতে লাগলো, জঙ্গলের
এই দিকটায় হিংস্র প্রাণীর আনাগোনা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে মাঝে মাঝে বন্য বরাহের
আবির্ভাব ঘটে। আজ তেমন দুই একটা পেয়ে গেলে মন্দ হয়না। বহুদিন বুনো চিতাও শিকার করা
হয়নি। এইসব ভাবতে ভাবতেই দলবল নিয়ে বনের ভিতরে প্রবেশ করল কুমার দ্রুতকের পিঠে
চেপে। অনেকক্ষণ ঘুরেও শিকার করার মত তেমন কিছু চোখে পড়লোনা। সূর্য ক্রমেই মাঝ
আকাশে উঠে আসছে। বাড়ছে রোদের তাপ। বনের বেশ ভিতরে একটা বড় দীঘির কাছে এসে থামল
রাজকুমার। দ্রুতকের পীঠ থেকে নেমে তাকে ছেড়ে দিল ঘাস আর জল খাওয়ার জন্য। দীঘির
আশেপাশে প্রচুর ঘাসঝোপ। বন্য প্রাণীরাও এখানে আসে জল খেতে। বিশেষ করে হরিণ।
রাজকুমার একটি প্রশস্ত গাছের ছায়ার নীচে গিয়ে দাঁড়ালো। দলের লোকজনের মৃদু গুঞ্জন
ছাড়া চারপাশ বেশ নীরব। শুধু একটা ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে। হঠাৎই রাজকুমারের মনে হল
দীঘির ওপারের বেশ বড় একটা ঘাসঝোপ যেন নড়ে উঠল। মুহূর্তে টানটান হয়ে উঠলো কুমার।
হাতে চলে এল তীর ধনুক। নিশ্চয় ঝোপের ভিতর রয়েছে কোন জানোয়ার। ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে
দলের সবাইকে চুপ করে থাকার ইশারা করল। চারিদিকে নেমে এল নিস্তব্ধতা। কিন্তু ঘাস
ঝোপে আর কোন নড়াচড়া নেই। দ্রুতক এক মনে ঘাস খেয়ে চলেছে। ডেকে চলেছে ঘুঘু। রাজকুমার
একটু ইতস্তত করল। তবে কি সে ভুল দেখেছে? নাকি বাতাসের খেলা? একটু পর শিথিল করল সে
তার স্নায়ু। নামিয়ে নিল উদ্যত তীর ধনুক। ঠিক তখনি আবার বেশ জোরেশোরে নড়ে উঠলো ঝোপ।
দ্রুতকও সেদিকে তাকিয়ে ডেকে উঠলো তীব্রস্বরে। নিমেষের মধ্যে রাজকুমারের তীর জ্যা
মুক্ত হোল। আর সাথে সাথেই ঝোপের ভেতর থেকে ভেসে এল আর্তনাদ। মানুষের আর্তনাদ!
অস্ত্র ফেলে সাথে সাথে ছুটে গেল রাজকুমার। পেছনে ছুটল দলের অন্যান্যরা।
মাথা সমান উঁচু ঘাস সরিয়ে ঝোপের ভেতর ঢুকে তারা দেখল মাটিতে পড়ে আছে এক মানুষ।
উরুতে তার বিঁধে রয়েছে রাজকুমারের ছোঁড়া তীর। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। মানুষটির
আশেপাশে কয়েকটি শূন্য পাখির খাঁচা আর পাখি ধরা ফাঁদ। কালবিলম্ব না করে তাকে
পাঁজাকোলা করে তুলে নিল রাজকুমার। ছুটল ঘোড়ার দিকে।
ক্রমশঃ
ক্রমশঃ